চিত্রনায়ক সোহেল রানা। প্রকৃত নাম মাসুদ পারভেজ। ’৭১-এর রণাঙ্গনের একজন সশস্ত্র যোদ্ধা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ প্রযোজকও তিনি।
১৯৭৩ সালে ‘সোহেল রানা’ নাম ধারণ করে ‘মাসুদ রানা’ ছবির নায়ক হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা লাভ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, বর্তমান ব্যস্ততা ও সমসাময়িক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত আলাপে জানিয়েছেন নানা কথা।
যুগান্তর: আপনি আসলে কার অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?
সোহেল রানা: আমি যখন ছাত্ররাজীতিতে প্রবেশ করি ঠিক তখন থেকেই বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে নিজে যুক্ত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকবাল হলে থাকাকালীন স্বাধীনতা অন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার পর পাকসেনাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। নিজের জীবন বাজি রেখেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি।
যুগান্তর: যুদ্ধকালীন সে দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে?
সোহেল রানা: সে দিনগুলোর কথা তো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। টানা ৯ মাস হানাদারদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি। আমি হয়তো আজ বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষকে দেখেছি রাস্তায় মরে থাকতে। নির্মমভাবে কত মানুষ না খেয়ে, পুড়ে, ধর্ষিত হয়ে মারা গেছে। সে দিনগুলোর কথা মনে হলে কান্নায় ভেঙে পড়ি। আসলে আমরা কতটা নির্যাতিত ছিলাম।
যুগান্তর: আপনি কি মনে করেন বর্তমান প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে?
সোহেল রানা: আমরা স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে পেরেছি বলে মনে হয় না! কথায় কথায় বলছে স্বাধীনতা স্বপক্ষীয় শক্তি, বিপক্ষীয় শক্তি, পাকিস্তানের পক্ষের শক্তি। মুক্তিযুদ্ধকে যদি ৪০ ভাগে ভাগ করা হয়, দেশটাও তো তেমনি ভাগ হয়ে গেছে।
যুগান্তর: বর্তমান প্রজন্ম তো প্রযুক্তির আগ্রাসনে ধাবিত হচ্ছে। সামনে আমরা কোন প্রজন্ম পাব বলে আপনি মনে করেন?
সোহেল রানা: প্রযুক্তি এখন সব জায়গায় বিরাজমান। আমার ঘরেও সে ধারা অব্যাহত। আমার সন্তান এখন ভাত খায় না বললেই চলে। বিদেশি কি একটি জুস খায়, যার ফলে ভাত-মাছ খেতে হয় না তার। এমন উদ্ভট বিষয় এখন সব জায়গায়। মানুষ এখন ঘরে বসে সব করতে চায়।
আমি আজ বরিশাল যাব, ঘরে বসে মোবাইল ঘঁষে টিকিট পেয়ে যাই। কাজ সহজ হলে আমরা সব ক্ষেত্রে ফল কিন্তু সহজ পাচ্ছি না। মানুষ এখন রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছে।
খবরের কাগজে চোখ মেলতেই আমরা দেশের যে খবর পাই, তা কিন্তু সুখকর নয়। এর জন্য আমরাও অনেকাংশে দায়ী। এখনও সময় আছে প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম, চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের মায়া আরও জন্মাতে হবে। না হলে রোবট আর এ প্রজন্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে বলে আমার মনে হয় না।
যুগান্তর: দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই তো ‘ওরা ১১ জন’ নামে মুক্তিযুদ্ধের ছবি প্রযোজনা করলেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বলুন?
সোহেল রানা: ‘ওরা ১১ জন’ মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র। একে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বলা যাবে না। কারণ, এ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি জীবনের নানা বাঁক, উত্থান-পতন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের নানা কথা উঠে এসেছে। তাই আমি একে অন্য দশটির মতো ছবি বলতে চাই। ‘ওরা ১১ জন’ ওই সময় ব্যবসা সফল হয়েছিল। এ ছবির লভ্যাংশ হিসেবে ৬ লাখ টাকা পেয়েছিলাম, যা এখনকার ৬ কোটি টাকার সমান।
যুগান্তর: বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ছবি তেমন নির্মিত হচ্ছে না। এর কারণ কী হতে পারে?
সোহেল রানা: বেশ কয়েকটি ছবি আগে নির্মিত হয়েছে। কিছু কিছু ছবিকে মুক্তিযুদ্ধের ছবি বলে দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সঠিক ইতিহাসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র খুব বেশি নির্মিত হয়নি।
তা ছাড়া এখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যুদ্ধের সময়কার সরঞ্জাম পাওয়া যাবে না। পরিবেশও নেই। বর্তমান বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন পরিবেশ তৈরি করা কঠিন ব্যাপার। এ কারণে শতভাগ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
যুগান্তর: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এখন যে ছবিগুলো নির্মিত হচ্ছে তা কি দেখা হয়?
সোহেল রানা: এগুলো কিসের জন্য, কী কারণে দেখব? বর্তমানে যারা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি নির্মাণ করছেন সেগুলো তো কল্পনার ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করছেন। তবে তাদের আবেগ কিংবা চিন্তাধারাকে আমি ছোট করে দেখছি না। তারা হয়তো যেটা করছেন সঠিক বিষয়টিকে সঠিকভাবে তুলে আনতে পারছেন না।
মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে ছবি নির্মিত হচ্ছে। কে বানাচ্ছেন, কারা বানাচ্ছেন, কীভাবে বানাচ্ছেন, তাও কিন্তু জানি না।
যুগান্তর: একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কি কোনো অভিযোগ কিংবা অভিমান আছে?
সোহেল রানা: আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছি। আমরা একটি পতাকার জন্য যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা তা পেয়েছি। মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু এখন তাদের যথাযথ সম্মান দেয়া হচ্ছে না। আমি মনে করি, ‘মুক্তিযুদ্ধ ভাতা’ দিয়ে তাদের আপমাণিত করা হচ্ছে। তারা কেন ‘ভাতা’ নেবে। ‘ভাতা’ দেয়া হয় তো দুস্থদের। আমাদের দিতে হবে সম্মান তথা সম্মানী।
যুগান্তর: বিজয় দিবস উপলক্ষে তরুণ প্রজন্মকে কী পরমর্শ দেবেন?
সোহেল রানা: তরুণ প্রজন্মকে আগে তাদের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। স্বাধীনতার মর্মার্থ বুঝতে হবে। স্বাধীনতার মানে কী তা জানতে হবে। স্বাধীনতা আমাদের অহঙ্কার। তাই তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। এর জন্য তাদের আরও বেশি বেশি বই পড়তে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখতে হবে। তবেই সুখি-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে উঠবে।
যুগান্তর: মৃত্যুর আগে কেমন বাংলাদেশ দেখে যেতে চান?
সোহেল রানা: সবারই ভালো কিছুর প্রত্যাশা থাকে। আমরা যে অর্থে এ দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছি, সে রকম দেশ এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আর বর্তমানে যেমন দেশ দেখছি আল্লাহতায়ালা তা-ই আমার ভাগ্যে রেখেছেন। আমরা ভালো কিছু করলে ভালো একটি পরিবেশ দেখে যেতে পারব। আমি চাই দেশের মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াক। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে কাজ করুক।